বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল রচনা done
বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল রচনা
পাঠক বৃন্দ আপনাদের সবাইকে জানাই আসসালামু আলাইকুম রাহমাতুল্লাহে বারাকাতুহু । কেমন আছেন আপনারা সবাই ? আশা করি অনেক ভাল আছেন । আলহামদুলিল্লাহ আমরা অনেক ভালো আছি । আজকে আমরা আপনাদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল রচনা |বঙ্গবন্ধুর ছোট বেলার রচনা |পোস্টটি দয়া করে সম্পূর্ণ পড়বেন।
ছবির মতো একটি গ্রাম। গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। জেলা গোপালগঞ্জ। তখন গোপালগঞ্জ ছিল ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা। মধুমতী নদীর তীরে। মধুমতীর অনেক শাখা। তেমন এক শাখার নাম বাইগার নদী। টুঙ্গিপাড়া এই নদীর ধারে। গভীর মমতায় গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে গেছে। মধুমতীতে গিয়ে মিশেছে।
নদীর দুই তীরে কত গাছপালা! হিজল বরুণ তাল তমাল। কত বুনোফুলের ঝোপ! বাঁশবন ছায়া ফেলে রেখেছে নদীর পানিতে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। নদীতে অনেক নৌকার চলাচল। হালে বসা মাঝি দরাজ গলায় ভাটিয়ালি গায়। গাছে গাছে ডাকে পাখিরা। হাওয়ায় ভাসে ফুলের গন্ধ। নদী বয়ে যায় কুলকুল শব্দে।
প্রায় ২০০ বছর আগে মধুমতী বয়ে যেত টুঙ্গিপাড়া ঘেঁষে। নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল বসতি। ধীরে ধীরে সরে গেছে নদী। চর জাগার পর নতুন নতুন গ্রাম হয়েছে। স্নিগ্ধ সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ। যাতায়াত করতে হতো নৌকায়। এই টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
দরবেশ শেখ আউয়াল ছিলেন ইরাকের লোক। এ দেশে এসেছিলেন পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারক হিসেবে। প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। তাঁর বংশধর শেখ বোরহানউদ্দিন টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন। এই বংশের শেখ আবদুল হামিদ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর দাদা। তাঁর পুত্র শেখ লুত্ফর রহমান বঙ্গবন্ধুর পিতা।
শেখ আবদুল হামিদের সময় থেকে এই পরিবারে ইংরেজি লেখাপড়া শুরু হয়। শেখ আবদুল হামিদ হঠাৎই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বড় ছেলেও মারা যান। তখন সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে শেখ লুত্ফর রহমানের ওপর। তিনি তখন এন্ট্রান্স পড়েন। লেখাপড়া ছেড়ে চাকরিতে ঢুকলেন। দেওয়ানি আদালতে সেরেস্তাদার হলেন।
শেখ আবদুল হামিদের বড় ভাই শেখ আবদুল মজিদের কোনো ছেলে ছিল না। ছিল চার মেয়ে। শেখ লুত্ফর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ে দেন। সেই মেয়ে সায়েরা খাতুনকে তাঁর সব সম্পত্তি লিখে দেন।
এই দম্পতির ঘরে জন্মান বঙ্গবন্ধু। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। দিনটি ছিল বুধবার।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ি ছিল বিশাল। ২০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল বড় বড় চারটি দালান। কলকাতা থেকে মিস্ত্রিরা এসে শুরু করেছিলেন বাড়ির কাজ। শেষ হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। দিনে দিনে ক্ষয়ে যায় দালানগুলো। ধসে পড়ে। সেগুলোতে আর বসবাস করা যেত না। এসব দালানের পাশেই টিনের ঘর করা হয়েছিল। সে রকম এক ঘরেই জন্মান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল মজিদ আকিকার সময় তাঁর নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মেয়েকে বললেন, ‘মা সায়েরা, তোর ছেলের এমন নাম রাখলাম যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’
এই নাম সত্যি সত্যি জগৎজোড়া খ্যাত হয়েছে। তিনি মিশে আছেন আমাদের রক্তে। আমাদের অন্তর আলোকিত হয়ে আছে তাঁর আদর্শে।
মা–বাবা বঙ্গবন্ধুকে ডাকতেন ‘খোকা’ নামে।
শেখ লুত্ফর রহমানের সংসারে জন্মান চার মেয়ে ও দুই ছেলে। দুই মেয়ের পর প্রথম পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর আরও দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মা–বাবার প্রথম পুত্র মুজিব হয়ে উঠলেন পরিবারের নয়নের মণি।
মুজিবের শৈশব কেটেছে পরিবারের প্রত্যেক মানুষের গভীর ভালোবাসায়। মা–বাবা, ভাই–বোন সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। স্নেহ–মমতা–আদরে ভরিয়ে রাখেন। বিশাল শেখ পরিবারের সবাই খোকা বলতে অজ্ঞান।
শৈশবের দিনগুলো কত না আনন্দে কাটতে লাগল! গ্রামের মেঠোপথের ধুলো মেখে, বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের কুয়াশায় পায়ে শিশির মেখে, হেমন্তের নীল আকাশের তলায়, ফসলের মাঠে ঘুরে ঘুরে বড় হতে লাগলেন মুজিব। বাইগার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আর সাঁতার কেটে দিন কেটে যায়। তালগাছে বাসা বেঁধেছে বাবুই পাখি। কী অপূর্ব দক্ষতায় পাখিগুলো তৈরি করে তাদের বাসা! মাছরাঙা বসে থাকে খাল, পুকুর বা নদীর ধারের গাছপালায়। হঠাৎই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পানিতে। ডুব দিয়ে ধরে আনে মাছ। মুজিব মাছরাঙা পাখি খেয়াল করেন। ভোরবেলার দোয়েল পাখির ডাক তাঁকে মুগ্ধ করে। বাংলার প্রকৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। এই দেশটি তাঁর অন্তরের সবখানি জায়গা দখল করে সেই শৈশবেই।
একদিন কোথা থেকে একটা শালিক পাখির ছানা ধরে আনলেন। আরেক দিন আনলেন একটা ময়না পাখির ছানা। অতিযত্নে ছানা দুটিকে খাওয়ান। তারপর বানর ও কুকুর পুষতে লাগলেন। এই প্রাণী দুটি এত ভক্ত হলো তাঁর, তিনি যা বলেন তা–ই করে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণ বানর আর কুকুর আছে তাঁর সঙ্গে। শালিক পাখির ছানা আর ময়না পাখির ছানা কথা বলতে শিখেছে। শিস দিতে শিখেছে। এসব পোষা পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি অপরিসীম মমতা তাঁর। এদের কেউ অবহেলা করলে তা সহ্য করতে পারতেন না।
শেখবাড়ির দক্ষিণ–পশ্চিম দিক ঘেঁষে সরু একটা খাল। খালের পাড়েই শেখবাড়ির কাচারিঘর। কাচারিঘরের পাশে মাস্টার, পণ্ডিতমশাই আর মৌলভি সাহেবদের থাকার ঘর। তাঁরা তিনজনই গৃহশিক্ষক। এই শিক্ষকদের কাছে মুজিব বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও আরবি শিখতে লাগলেন।
বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল। মুজিবকে এই স্কুলে ভর্তি করা হলো। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুলে যেতে হয়। একদিন ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। নৌকা খালে ডুবে গেল। মুজিব পানিতে পড়ে গেলেন। ঘটনা শুনে মা খুবই ভয় পেলেন। কিছুতেই তিনি তাঁর ছেলেকে আর ওই স্কুলে পাঠালেন না।
শেখ লুত্ফর রহমান তখন গোপালগঞ্জ শহরে চাকরি করছেন। মুজিব চলে গেলেন আব্বার কাছে। ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। মা শহরে গিয়ে থাকতেন না। কারণ, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি তিনি দেখাশোনা করতেন।
মুজিবের দাদা ও নানার ঘর পাশাপাশি। মা, ভাইবোনের সঙ্গে নানার ঘরেই থাকতেন তিনি। গোপালগঞ্জে গিয়ে আব্বার কাছে থাকেন। লেখাপড়া করেন। আব্বার গলা ধরে ঘুমান। মা যেমন ভালোবাসেন, আব্বাও তেমনই ভালোবাসেন।
গোপালগঞ্জে পড়াশোনা চলছে। মাঝখানে একবার মাদারীপুরে বদলি হলেন আব্বা। কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরে গিয়েও লেখাপড়া করতে হলো। পরে আবার ফিরে এলেন গোপালগঞ্জে। এখানেই কাটতে লাগল তাঁর কিশোরবেলা।
মুজিব ছিলেন খুব রোগা। মা সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তাঁর শরীর ভালো করা যায়। বড় বোনেরা ব্যস্ত থাকতেন। খেয়াল রাখতেন ভাইয়ের দিকে। ভাইবোনেরা তাঁকে ডাকতেন ‘মিয়াভাই’ বলে। তাঁদের দেখাদেখি গ্রামের মানুষজনের কাছেও তিনি ‘মিয়াভাই’ হয়ে গেলেন। সেই বয়সেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা করতেন। গ্রামের এবাড়ি–ওবাড়ি যাচ্ছেন। প্রত্যেকের খবর নিচ্ছেন। বেশ একধরনের ব্যস্ততা।
এদিকে মায়ের ব্যস্ততা তাঁর খোকাকে নিয়ে। খোকার শরীর কীভাবে ভালো রাখা যায়? দুধের গ্লাস নিয়ে ছেলের পেছনে ছুটছেন। ঘরে তৈরি হচ্ছে ছানা, মাখন, ঘি। সময়মতো ছেলেকে সেসব খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। বাগানের ফল আর নদীর তাজা মাছ হাতের কাছে রাখা হচ্ছে। তারপরও খোকার স্বাস্থ্য ভালো হয় না। ছিপছিপে পাতলা শরীর। এই নিয়ে মায়ের আফসোসের সীমা নেই।
বাড়ির এত ভালো ভালো খাবারের দিকে মোটেই নজর ছিল না মুজিবের। তিনি পছন্দ করেন ভাত আর মাছের ঝোল। পছন্দ করেন ডাল আর সবজি। খুবই সাধারণ খাবার। তবে সবশেষে দুধভাত, কলা ও গুড় থাকতে হবে।
ছোটবেলা থেকে মুজিব অত্যন্ত হৃদয়বান। মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। গভীর মমতা মানুষের জন্য। তখনকার দিনে পড়াশোনার এত সুযোগ ছিল না। বেশির ভাগ মানুষই ছিল গরিব। একটু সচ্ছল গৃহস্থবাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করত। চার–পাঁচ মাইল দূরে স্কুল। সকালে ভাত খেয়ে হেঁটে যেতে হতো। সারা দিনে আর খাওয়া নেই। স্কুল ছুটির পর আবার এতটা পথ হেঁটে ফেরা। স্কুল থেকে ফেরার পর এসব ছেলেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন তিনি। বাড়ি ফিরেই দুধভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সেই খাবার সবাইকে নিয়েই খেতেন।
প্রতি মাসেই মুজিবের জন্য বেশ কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ কী?
দেখা গেল কোনো গরিব ছেলে ছাতা কিনতে পারছে না। চার–পাঁচ মাইল পথ ঠা ঠা রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে স্কুলে। বর্ষায় যেতে হচ্ছে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে। নিজের ছাতা তিনি তাদের দিয়ে দিতেন।
বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা আমগাছ ছিল। স্কুল ছুটির সময় হলে মা সেই আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ও রকম একদিন মা দেখেন, তাঁর খোকা শুধু গায়ের চাদরটা জড়িয়ে হেঁটে আসছেন। স্কুলে যেতেন পাজামা–পাঞ্জাবি পরে। শীতকালে চাদর পরতেন। সেদিন শুধু চাদর জড়িয়েই বাড়ি ফিরছেন। মা অবাক। কী ব্যাপার? পাজামা–পাঞ্জাবি কোথায়?
জানা গেল, তিনি তাঁর পাজামা–পাঞ্জাবি একটি ছেলেকে দিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলের পরনের জামাকাপড় একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছিল। পরার উপযুক্ত না।
একবার মাঘ মাসে বেজায় শীত পড়েছে। দিনরাত কনকনে ঠান্ডা। এ রকম একদিন ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে বসে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ঠকঠক করে কাঁপছে আর কাঁদছে। তিনি নিজের চাদর খুলে বৃদ্ধের গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই মুজিব জন্মেছিলেন। বড় হয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি হতে পেরেছিলেন বাংলার জনমানুষের নেতা। মানুষ আর দেশকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।
Tag:বঙ্গবন্ধুর শিশুকাল রচনা, বঙ্গবন্ধুর ছোট বেলার রচনা